আহলুস্‌ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট আল্লাহ্‌র ‘ইরাদাহ’ (إرادة) বা ‘ইচ্ছা’-এর পরিচয়

পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায়, আল্লাহ্‌র ইচ্ছা দুই ধরনের: (১) ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’ (إرادة كونية) বা ‘সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছা’। (২) ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’ (إرادة شرعية) বা ‘শরঈ ইচ্ছা’।[1]

(১) ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’ (إرادة كونية) বা সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছাঃ এই প্রকারের ইচ্ছা আল্লাহ্‌র রাজ্যের সবকিছুকে শামিল করে। আল্লাহ যা কিছু করতে চান, সবকিছুর সাথে এই প্রকার ইচ্ছার সম্পর্ক রয়েছে।[2] মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ﴾ [سورة البروج: 16]

‘তিনি যা চান, তাই করেন’ (বুরূজ ১৬)। এই প্রকার ইচ্ছা আল্লাহ্‌র আদেশ, ভালবাসা বা সন্তুষ্টিকে অপরিহার্য গণ্য করে না। সেজন্য এই প্রকার ইচ্ছার মাধ্যমে এমন কিছু ঘটতে পারে, যা আল্লাহ ভালবাসেন বা যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন। আবার এমন কিছুও ঘটতে পারে, যা তিনি ভালবাসেন না এবং যাতে তিনি সন্তুষ্টও হন না। যেমনঃ আল্লাহ ইবলীসকে সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু তাকে তিনি ভালবাসেন না। অপরপক্ষে তিনি মুমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাকে ভালবাসেন। অনুরূপভাবে কখনও আল্লাহ এমন কিছু সৃষ্টি করেন, যার নির্দেশ তিনি দেন না। যেমনঃ পাপীর পাপাচার। আবার কখনও তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করেন, যার নির্দেশ তিনি দেন। যেমনঃ মুমিনের আনুগত্য। এমনিভাবে কখনও আল্লাহ এমন কিছুর নির্দেশ দেন, যা তিনি সৃষ্টিই করতে চাননি। যেমনঃ আল্লাহ যাকে কোন বিষয়ে আনুগত্যের তাওফীক্ব দেননি, তার সাথে সম্পৃক্ত আনুগত্য। আবার কখনও তিনি এমন কিছুর নির্দেশ দেন, যা সৃষ্টি করে থাকেন। যেমনঃ আল্লাহ কর্তৃক আনুগত্যের তাওফীক্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির আনুগত্য।[3]

ইরাদাহ কাউনিইয়াহকে বাংলা ভাষায় ‘ইচ্ছা’ অর্থে ব্যবহার করা যায়। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,

 ﴿وَلَا يَنفَعُكُمْ نُصْحِي إِنْ أَرَدتُّ أَنْ أَنصَحَ لَكُمْ إِن كَانَ اللَّهُ يُرِيدُ أَن يُغْوِيَكُمْ﴾ [سورة هود: 34]

‘আর আমি তোমাদের নছীহত করতে চাইলেও তা তোমাদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে গোমরাহ করতে চান’ (হূদ ৩৪)।[4] এখানে ‘ইচ্ছা’-কে ভালবাসা বা সন্তুষ্টি অর্থে নেওয়া যাবে না।

(২) ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’ (إرادة شرعية) বা শরঈ ইচ্ছাঃ আল্লাহ যে বিষয়টি তাঁর বান্দা কর্তৃক বাস্তবায়িত হওয়াকে কামনা করেন এবং ভালবাসেন, এমন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ইচ্ছাকে শরঈ ইচ্ছা বলে। এই প্রকার ইচ্ছা আল্লাহ্‌র ভালবাসা এবং সন্তুষ্টির সাথে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। অর্থাৎ তিনি তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়টিকে ভালবাসেন, ইহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, ইহার বাস্তবায়নকারীর প্রতি খুশী হন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দান করেন। তবে তাঁর পছন্দনীয় বিষয়ের সংঘটন অপরিহার্য করে না। অবশ্য আল্লাহ্‌র পছন্দনীয় বিষয়টি ইরাদাহ কাউনিইয়ার সাথে সম্পর্কিত হলে তখন সেটির সংঘটন অপরিহার্য করে।[5]

ইরাদাহ শারঈয়াহকে বাংলায় আল্লাহ্‌র ‘সন্তুষ্টি ও ভালবাসা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,

﴿وَاللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ﴾ [سورة النساء: 27]

‘আল্লাহ তোমাদের তওবা কবূল করতে চান’ (নিসা ২৭)।[6] এখানে ইরাদাহ শব্দটি ভালোবাসা বা সন্তুষ্টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পারস্পরিক সম্মিলন এবং বিচ্ছিন্নতার চারটি অবস্থা। যথাঃ

প্রথম অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে উভয় প্রকার ইরাদাহ বিদ্যমান থাকে। আর মুমিন কর্তক সংঘটিত যাবতীয় সৎকর্ম এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং সকল মুমিনের ঈমান ও সৎকর্ম। উদাহরণ স্বরূপ আরো বলা যেতে পারে, কোন নেককার বান্দা ছালাত আদায় করলে তার ছালাতে উভয় প্রকার ইরাদাহ্‌র সমন্বয় ঘটে। কারণ ছালাত আল্লাহ্‌র প্রিয়, তিনি তা কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইরাদাহ শারইয়াহ। আর যেহেতু ঐ মুমিন ব্যক্তি ছালাত আদায় করে ফেলেছে, সেহেতু তা ইরাদাহ কাউনিইয়াহ। কারণ আল্লাহ্‌র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ না থাকলে তা কখনই ঘটত না।

অনুরূপভাবে একজন মুমিনের ঈমানে দুই প্রকার ইরাদাহ্‌র সমন্বয় ঘটে। কেননা মহান আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে যেমনি চেয়েছেন যে, সে অনুগত মুমিন হবে, তেমনি ধর্মীয়ভাবেও তার পক্ষ থেকে তিনি ঈমান কামনা করেছেন।

দ্বিতীয় অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে শুধুমাত্র ইরাদাহ শারঈয়াহ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ যেসব সৎকর্মের আদেশ করেছেন; কিন্তু কাফের এবং পাপী-তাপীরা আল্লাহ্‌র নির্দেশ লংঘন করে সেগুলি বাস্তবায়ন করেনি- এই ধরনের সৎকর্ম এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ আবু জাহ্‌লসহ সকল কাফেরের ঈমান এবং সৎকর্ম। অনুরূপভাবে কোন কাফেরের ঈমানে এবং পাপীর আনুগত্যে শুধুমাত্র ইরাদাহ শারঈয়াহ পাওয়া যায়। কেননা এই ঈমান এবং আনুগত্য আল্লাহ্‌র পছন্দ। আর পছন্দ বলেই তাতে ইরাদাহ শারঈয়াহ আছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র নির্দেশ সত্ত্বেও সে যেহেতু ঈমান না এনে কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, সেহেতু তাতে (অর্থাৎ তার ঈমান আনয়নে) ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নেই। কারণ ইরাদাহ কাউনিইয়াহ থাকলে সে কাফের অবস্থায় মরত না; বরং অবশ্যই ঈমান আনত।

তৃতীয় অবস্থাঃ কোন কোন বিষয়ের সাথে শুধুমাত্র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু আদেশ করেননি- এমন সকল পাপ কাজ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ মানুষ কর্তৃক ঘটে যাওয়া সকল পাপকর্ম। কারণ আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে না চাইলে সেগুলি ঘটত না। অনুরূপভাবে কোন কাফেরের কুফরীতে শুধুমাত্র ইরাদাহ কাউনিইয়াহ মওজূদ থাকে, ইরাদাহ শারঈয়াহ নয়। কেননা যেহেতু তার পক্ষ থেকে কুফরী ঘটে গেছে, সেহেতু তা ইরাদাহ কাউনিইয়াহ। কারণ ইরাদাহ কাউনিইয়াহ না থাকলে তা কখনই ঘটত না। আর যেহেতু আল্লাহ কুফরীকে পছন্দ করেন না, সেহেতু তা ইরাদাহ শারঈয়াহ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ﴾ [سورة الزمر: 7]

‘তিনি তাঁর বান্দাদের কাফের হয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না’ (যুমার ৭)।

চতুর্থ অবস্থাঃ কিছু কিছু বিষয়ের সাথে দুই প্রকার ইরাদাহ্‌র কোনটিরই সম্পর্ক থাকে না। যেমনঃ ঈমান অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কোন মুমিন ব্যক্তির কুফরীতে কোন প্রকার ইরাদাহ্‌র অস্তিত্ব থাকে না। কেননা আল্লাহ কুফরী পছন্দ করেন না। আর সেজন্যই তাতে ইরাদাহ শারঈয়াহ নেই। পক্ষান্তরে যেহেতু তা উক্ত মুমিন কর্তৃক সংঘটিত হয়নি, সেহেতু তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহও নেই। কারণ তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ থাকলে সে মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করত না; বরং কুফরী কর্ম নিয়েই দুনিয়া ছাড়ত।[7]


ইরাদাহ কাউনিইয়াহ এবং ইরাদাহ শারঈয়াহ-এর মধ্যে পার্থক্যঃ

১. ইরাদাহ কাউনিইয়াহকে আল্লাহ ভালবাসতেও পারেন, নাও পারেন। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহকে তিনি অবশ্যই ভালবাসেন। সেজন্য আল্লাহ পাপ সৃষ্টি করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি পাপকে ভালবাসেন না।

২. ইরাদাহ কাউনিইয়াহর মাধ্যমে কখনও অন্য কিছুকে উদ্দেশ্য করা হয়। যেমনঃ আল্লাহ কর্তৃক ইবলীস এবং সমস্ত পাপকর্মের সৃষ্টি। প্রশ্ন হল, তাহলে এগুলি সৃষ্টির পেছনে রহস্য কি? জবাব হল, এগুলি থাকার কারণে বান্দা সবসময় সৎকর্মের জন্য মরণপণ চেষ্টা করবে, সে আল্লাহ্‌র নিকট তওবা করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

পক্ষান্তরে ইরাদাহ শারঈয়াহর মাধ্যমে অন্য কিছুকে উদ্দেশ্য করা হয়না; বরং সরাসরি এই ইচ্ছাই উদ্দেশ্য হয়। যেমনঃ আল্লাহ সরাসরি আনুগত্যকে ভালবাসেন এবং এর প্রতি সন্তুষ্ট হন।

৩. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নিশ্চিত বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহ বাস্তবায়িত হতেও পারে, নাও পারে। তবে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ্‌র সাথে এটি সম্পর্কযুক্ত হলে এটিও অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।

৪. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী নয়। তবে ইহা ইরাদাহ শারঈয়াহ্‌র সাথে সম্পর্কযুক্ত হলে আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী হবে।

পক্ষান্তরে ইরাদাহ শারঈয়াহ আদেশজ্ঞাপক হওয়া যরূরী। সেজন্য শরঈভাবে আল্লাহ যা কিছুর ইচ্ছা করেন, তার সবগুলিকে তিনি বাস্তবায়নের নির্দেশ দান করেন।[8]

৫. ইরাদাহ কাউনিইয়াহ আল্লাহ্‌র রুবূবিইয়াত এবং সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু ইরাদাহ শারঈয়াহ আল্লাহ্‌র উলূহিইয়াত এবং শরী‘আতের সাথে সম্পর্কিত।[9]

[1]. সম্মানিত পাঠক! ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’-এর প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘আল-মাশীআহ’ (اَلْمَشِيْئَةُ) বা ইচ্ছা। আর ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’-এর প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘আল-মুহাব্বাতু ওয়ার-রেযা’ (اَلْمَحَبَّةُ وَالرِّضَا) বা ভালবাসা এবং সন্তুষ্টি। এতটুকু মনে রাখলেই তাক্বদীরের বেশ কয়েকটি দিক উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তবে পরিভাষা দু’টিকে আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে আরবী ভাষাতেই ‘ইরাদাহ কাউনিইয়াহ’ এবং ‘ইরাদাহ শারঈয়াহ’ ব্যবহার করব।

[2]. ইবনে তায়মিইয়াহ, মিনহাজুস-সুন্নাহ, তাহক্বীক্ব: ড. মুহাম্মাদ রশাদ সালেম, (মুওয়াস্‌সাসাতু ক্বুরত্বুবা, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৬ ইং), ৩/১৫৬ ও ১৮০।

[3]. মিনহাজুস-সুন্নাহ ৩/১৫৬, ১৮০; শিফাউল আলীল/৫৪৯-৫৫১; আল-মুখতাছার ফী আক্বীদাতি আহলিস্ সুন্নাতি ফিল ক্বাদার/৫৫-৫৬।

[4]. মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল আক্বীদাতিল-ওয়াসেত্বিইয়াহ, (দারু ইবনিল জাওযী, ৪র্থ প্রকাশ: ১৪২৪ হি:), ২/২০৬।

[5]. মিনহাজুস-সুন্নাহ, ৩/১৫৬; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/১৮৮।

[6]. শারহুল আক্বীদাতিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, ২/২০৬।

[7]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/১৮৯; তাযকিরাতুল মু’তাসী শারহু আক্বীদাতিল হাফেয আব্দিল গাণী আল-মাক্বদেসী/১৫৩; আল-ঈমানু বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/৯৯।

[8]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/১৮৮-১৮৯; মিনহাজুস্‌ সুন্নাহ, ৩/১৬৪-১৬৫; আল-মুখতাছার ফী আক্বীদাতি আহলিস্‌ সুন্নাতি ফিল ক্বাদার/৫৮।

[9]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/৯৮।